গোলাম আলী নাইম ঢাকা বিশেষ প্রতিনিধিঃ
কখনো মানবিক করিডোর, কখনো প্যাসেজ কখনো বা চ্যানেল; আবার কখনো বলা হচ্ছে করিডোর দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, কখনও বলা হচ্ছে সিদ্ধান্ত হয়নি, আবার কেউ বলছে আলোচনা হয়েছে, কেউ বলছে আলোচনা হয়নি-
অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ কিংবা প্রেস সচিব, তাদের একেক জনের একেক রকম মন্তব্য গণমাধ্যমে আসছে। সরকারের দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিদের এমন অস্পষ্ট বক্তব্যে জনগণের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে! একই সাথে রাখাইনে করিডোর, চ্যানেল কিংবা ভিন্ন নামে কিছু দেয়ার ব্যাপারে সরকার কিছু একটা লুকাতে চাইছে বলে অভিযোগ স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির!
আজ ৭ মে, ২০২৫, বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির আহ্বায়ক মুহম্মদ জিয়াউল হক ও যুগ্ম আহবায়ক মুহিউদ্দিন রাহাত স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এসব অভিযোগ করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়- করিডোর কিংবা চ্যানেলের মত দেশের সার্বভৌমত্বের সাথে সম্পর্কিত একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এমন অস্পষ্ট, তথ্য লুকানো বা ধোঁয়াশাযুক্ত বক্তব্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি। পাশাপাশি আমরা রাখাইনে করিডোর, চ্যানেল কিংবা ভিন্ন নামে অনুরূপ কিছু দেয়া বা না দেয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানাচ্ছি।
একই সাথে বাংলাদেশের কাছে রাখাইনের কেউ মানবিক সহায়তা চেয়েছে কিনা, চাইলে তারা কারা- আরাকান আর্মি নাকি রোহিঙ্গা, নাকি বাইরের কেউ করিডোর/চ্যানেল দিতে চাপ দিচ্ছে, এতে বাংলাদেশের স্বার্থ কী, রোহিঙ্গাদের স্বার্থ কী সরকারকে সেটিও স্পষ্ট করতে হবে।
করিডোর দিলে যেসব সমস্যা হতে পারে সেটির ব্যাপারে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করে- বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি মনে করছে- কথিত মানবিক করিডোর, চ্যানেল কিংবা ভিন্ন নামে রাখাইনে কথিত মানবিক সহায়তা পাঠানোর চেষ্টা করা হলে এতে-
প্রথমত: বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বগত ঝুঁকি তৈরী হবে, দ্বিতীয়ত: গণহত্যাকারী আরাকান আর্মিকে সহায়তা ও শক্তিশালী করা হবে। ফলে তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর আরো গণহত্যা চালানোর সুযোগ পাবে, তৃতীয়ত: বাংলাদেশকে বিভিন্ন পরাশক্তি; বিশেষ করে আমেরিকা-চীন দ্বন্দ্বের বলির পাঠা বানানো হবে, এবং একই সাথে করিডোর বা চ্যানেল ইস্যুটিকে আমরা আমেরিকার ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্রাটেজির অংশ হিসেবেই দেখছি। যেখানে বাংলাদেশকে যোগদান করতে আমেরিকা দীর্ঘদিন যাবৎ চাপ প্রয়োগ করে আসছে।
এই ব্যাপারে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর গত ১০ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর দিল্লী হয়ে ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ যাতে ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্রাটেজির অংশ না হয় সেজন্য গত ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি একটি বিবৃতি প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্কও করেছিল।
বিবৃতিতে বলা হয়- নিজেদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের ব্যাপারে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও রাখাইনের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গি একইরকম। উভয়েই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। রোহিঙ্গারা মুসলমান হওয়ায় তারা রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না, বরং ‘বাঙ্গালী(বাংলাদেশী)’ ট্যাগ দিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইন থেকে বের করে দিতে চায়। তারই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক ২০১৭ সালে নতুন করে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা শুরু করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। আর এখন গণহত্যা চালাচ্ছে আরাকান আর্মি নামক নরপশুরা। গণহত্যা, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, বাস্তুচ্যুত করা, সম্ভ্রমহানী ও রোহিঙ্গা নারীদের দাসী বানানো থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যেটা জান্তার মত আরাকান আর্মি করছে না।
স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং এর স্থায়ী ও টেকসই সমাধান চায়।
স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি মনে করে- রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হলে সেটা এমনভাবে করতে হবে যাতে রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারে, নিজেদের ভূখণ্ড নিজেরাই উদ্ধার করে রাখাইনে ফিরে যেতে পারে এবং সেখানে স্থায়ী হতে পারে। এজন্য রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে রোহিঙ্গাদের সামনে রেখে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমেই। কোনো বিদেশী রাষ্ট্র কিংবা বিদেশী সংস্থার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা যাবে না।
রোহিঙ্গাদের টেকসই নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও মৌলিক-মানবাধিকারসহ তাদের নিজ ভূমি রাখাইনে ফিরিয়ে দিতে রোহিঙ্গা নেতৃত্ব তৈরি এবং কূটনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিকসহ সবদিক দিয়ে রোহিঙ্গাদের সক্ষম করে তোলা জরুরী। রোহিঙ্গাদের আত্মরক্ষা (Right to self-defense) ও বদলা নেবার অধিকার (Right to retaliation) এর ভিত্তিতে লাখ’খানেক রোহিঙ্গা তরুন-যুবককে বাছাই করে তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখাইনে পাঠাতে হবে তাদের নিজেদের ভূমি পুনরুদ্ধার করতে। এই অধিকারগুলো আন্তর্জাতিক আইন সম্মত। পাশাপাশি স্থায়ী ও টেকসই সমাধানকল্পে রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ও রোহিঙ্গা শাসিত অঞ্চল (রোহিঙ্গা ডোমিন্যান্ট স্টেট) হিসেবে গড়ে তুলতে সামরিক সহায়তা থেকে শুরু করে যা যা করা দরকার তার সবটাই করতে হবে।
যেহেতু রোহিঙ্গাদেরকে ‘বাঙ্গালী (বাংলাদেশী)’ ট্যাগ দিয়ে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং রোহিঙ্গাদের বোঝা বাংলাদেশকেই বইতে হচ্ছে, সেহেতু রোহিঙ্গাদের সক্ষম করে তোলার কাজ ও রাখাইনকে রোহিঙ্গা শাসিত অঞ্চল হিসেবে গড়বার দায়িত্ব বাংলাদেশকেই নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাখাইনে জান্তা কিংবা আরাকান আর্মি নয়, বরং রোহিঙ্গাদের স্বার্থই বাংলাদেশের স্বার্থ, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারাই বাংলাদেশের সীমানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অতএব, বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ-ই দেখতে হবে; জান্তা, আরাকান আর্মি কিংবা বিদেশী কোনো শক্তির স্বার্থ নয়।
"গণহত্যা বন্ধ করতে হবে এবং রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইন প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্তরে রাখতে হবে" এমন একটি প্রস্তাবনা আরাকান আর্মিকে দেয়া হয়েছে মর্মে রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ গতকাল ৬'মে'২৫ উল্লেখ করেছে।
"যদি আরাকান আর্মি গণহত্যা বন্ধ না করে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার না করে, সসম্মানে ফিরিয়ে না নেয়, তাহলে বার্মার জান্তা সরকারের মতো বাংলাদেশও 'আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে তালিকাভুক্ত করবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে" বাংলাদেশকে এই হুঁশিয়ারিও আরাকান আর্মিকে অবগত করতে হবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বহুপাক্ষিক; বিশেষ করে মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা নিতে পারে। যেমন- তুরস্ক, কাতার, গাম্বিয়া, পাকিস্তান, আরব রাষ্ট্রসমূহ, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র এবং আগ্রহী অন্যান্য রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমর্থন ও সহযোগিতা নিতে পারে। তবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকী হতে পারে এমন কোনো সম্ভাব্য রাষ্ট্র কিংবা সংস্থাকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা যাবে না।
একই সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টিসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক স্টেক যারা সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কনসার্ন এদেরকে নিয়ে সরকার আলাদা একটি ফোরামও তৈরী করতে পারে।
বিবৃতিতে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি অন্তর্বর্তী সরকারকে অতিদ্রুত উপরোক্ত ব্যবস্থাপনা হাতে নেয়ার জোর আহ্বান জানায়। এর বিপরীতে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ঝুঁকি তৈরী করতে পারে এমন কোনো করিডোর, চ্যানেল কিংবা ভিন্ন নামে কিছু করার চেষ্টা করা হলে ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ দেশপ্রেমিক জনগণকে সাথে নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবে মর্মে সরকারকে সাবধান করে।
আতিকুর রহমান আতিক কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত
যোগাযোগ : ০১৭৯৯-১৩৮৪৭১, ০১৯২২-১০৮৩৩৮
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত